ফাইল ছবি
মানবিক সংকটের অগ্নিদগ্ধ স্বপ্নগুলো, যখন বাস্তবতার তাপে আর্তিনাদ করে তখন কিন্তু সবাই দৃষ্টি ফেরায়। সম্প্রতি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সেই দৃষ্টির প্রতিফলন। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য এটি যেন এক নতুন আতঙ্কের নাম।বিপর্যয় ঘনিয়ে এলে আমরা প্রায়শই মানবিক সহায়তা এবং উদ্বাস্তু বাসীর মর্যাদা রক্ষা নিয়ে চিন্তা করি। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের প্রতিটি নিপাতিত ঘরে বন্দী জীবন, একভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। ফায়ারের শিখা শুধু শারীরিক নয়; এটি মানুষের আশা, স্বপ্ন এবং অস্তিত্বের সূত্র গুলো উড়িয়ে নিয়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডের ফলে কতগুলি পরিবার হয়েছে স্থান ছন্নছাড়া।
রোহিঙ্গারা দিন রাত সংগ্রাম করে বাঁচার জন্য যখন গৃহহীন হয়ে পড়ে, তখন তাদের চোখে দেখা যায় এক অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি। তাদের অবস্থার প্রকৃতিটি বুঝতে পারলে মনে হয়, এটি কেবল একটি দুর্ভোগের কাহিনি নয়, এটি মানবতা ও সহানুভূতির পরীক্ষা। এই ঘটনার পর সরকারের, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এবং মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিক্রিয়া জরুরি হয়ে পড়ে। মানবিক কাজের চেয়ে বড় কিছু নেই| এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এই সংকটে কারও কোনো জাতি, ধর্ম বা ভাষা প্রাধান্য পায় না সবাই সমান। অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা আমাদের পক্ষ থেকে দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও সহায়তার জন্য একটা চিন্তা প্রভাবিত করে। আমাদের উচিত রোহিঙ্গাদের প্রতি সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসা। যখন একজন মানুষের হৃদয়ে আগুন লেগে যায়, তখন সে কেবল ভোঁতা অস্ত্রের মতো নয়; সে সমাজের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হয়।
এই সংকট শুধু রোহিঙ্গাদের নয়, বরং আমাদের সকলের উক্ত দুর্দশা। অগ্নিকাণ্ডের পরস্থিতে রোহিঙ্গাদের রক্ষাকারী আমাদের কর্মকাণ্ডের জন্য আরও বেশি মানবিক দায়িত্বশীলতা দাবি করছে। মানবজাতির চেতনায় সঙ্গতি বজায় রাখতে, প্রতিবেদন রচনা করার সময় এসেছে, হাজারো অগ্নিকান্ডের মধ্যেও যাতে স্বপ্নগুলো অগ্নিমূর্তি ধারণ করতে পারে।”
রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ড: কক্সবাজারের ঘন বসতিতে বার্ষিক ট্র্যাজেডি ও মানবিক সংকটের গভীরতা
রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিম্নরূপ :
১. ২২ মার্চ ২০২১-এর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড (কুতুপালং-বালুখালি শিবির, কক্সবাজার), এই অগ্নিকাণ্ডে ১৫ জনের মৃত্যু ও ৫০০ জনেরও বেশি আহত হয়। প্রায় ১০,০০০ ঘরবাড়ি ও ৩৫০টি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল, মসজিদ) ধ্বংস হয়। ৪৫,০০০-এর বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হন।
২.জানুয়ারি ২০২২ (নয়াপারা শিবির, কক্সবাজার), আগুনে ১,২০০ এর বেশি আশ্রয়কেন্দ্র পুড়ে যায় এবং ৫,০০০ রোহিঙ্গা গৃহহীন হন।
৩. ৫মার্চ ২০২৩ (ক্যাম্প ১১, কক্সবাজার), ২,০০০ এর বেশি রোহিঙ্গা ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং ৩০০ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।
৪.২৪ ডিসেম্বর ২০২৪: কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে-১ ডাব্লিউতে একটি অগ্নিকাণ্ডে দুইজন নিহত হন এবং ৫০০-এরও বেশি ঘরবাড়ি ও অন্যান্য কাঠামো ধ্বংস হয়।
৫. ফেব্রুয়ারি ২০২৫: কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে-২৬ একটি অগ্নিকাণ্ডে একজন নিহত হন ও ৭ জন শিশু হারিয়ে যায় এবং ৫০-এরও বেশি ঘরবাড়ি ও অন্যান্য কাঠামো ধ্বংস হয়।
প্রধান কারণ ও প্রভাব: কারণ: বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, রান্নার সময় দুর্ঘটনা, বা মানব সৃষ্ট ঘটনা (জানাজানি থাকলেও প্রমাণিত নয়)।
প্রভাব: জীবনহানি, অবকাঠামো ধ্বংস, মানবিক সংকটের অবনতি এবং বাস্তুচ্যুতি।
চ্যালেঞ্জ: শিবিরগুলোর ঘনবসতি, বাঁশ ও টারপলিন অস্থায়ী ঘর, এবং অপর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা।
রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমানোর জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে:
১.অগ্নি প্রতিরোধমূলক অবকাঠামো উন্নয়ন:
ক) আশ্রয়কেন্দ্রের নকশা: দাহ্য উপকরণ (বাঁশ, টারপলিন) এর পরিবর্তে অগ্নিরোধী বা কম দাহ্য সামগ্রী ব্যবহার। শিবিরের মধ্যে পর্যাপ্ত ফাঁকা স্থান রেখে অগ্নি ছড়ানোর পথ বন্ধ করা।
খ) জল সরবরাহ: প্রতিটি ব্লকে পর্যাপ্ত ফায়ার হাইড্রেন্ট, পানি সংরক্ষণের ট্যাংক ও বালুর ড্রাম রাখা।
গ) বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা: নিরাপদ বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন ও নিয়মিত পরীক্ষা করে শর্ট-সার্কিটের ঝুঁকি কমানো।
২.সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ: ক) কমিউনিটি প্রশিক্ষণ: অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের ব্যবহার, নিরাপদ রান্নার পদ্ধতি (যেমন: সোলার কুকারের প্রচলন), এবং ধূমপান এড়ানোর মতো বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
খ) শিশু ও নারীদের অংশগ্রহণ: তাদেরকে অগ্নি নিরাপত্তা ড্রিল ও জরুরি প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা।
৩.জরুরি প্রতিক্রিয়া প্রস্তুতি: ক) অগ্নিনির্বাপণ দল গঠন: GbwRI Ges স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া টিম তৈরি এবং নিয়মিত মহড়ার আয়োজন।
খ) স্পষ্ট অভিযোজন পরিকল্পনা: শিবিরে জরুরি নিকাশী পথ চিহ্নিতকরণ এবং নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র নির্ধারণ।
৪.কমিউনিটি ভিত্তিক সমাধান: ক) স্থানীয় নেতৃত্বের সম্পৃক্ততা: কমিউনিটি নেতাদের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তাদের ভূমিকা নিশ্চিত করা।
খ) প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা: মোবাইল বা হ্যান্ড মাইকের মাধ্যমে দ্রুত তথ্য প্রচার।
৫.নীতিগত ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা:
ক) নিরাপদ শিবির নীতিমালা: জাতিসংঘের শরণার্থী এজেন্সি (BDGbGBPwmAvi) ও স্থানীয় সরকারের সমন্বয়ে অগ্নি নিরাপত্তা নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
খ) অর্থায়ন ও সম্পদ বরাদ্দ: আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির কাছ থেকে অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল নিশ্চিত করা।
৬.মনিটরিং ও মূল্যায়ন: ক) ঝুঁকি সমীক্ষা: নিয়মিত শিবিরের দুর্বলতা চিহ্নিতকরণ এবং পূর্বাভাসমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
খ) ঘটনার পর বিশ্লেষণ: প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করে ভবিষ্যতের জন্য পাঠ গ্রহণ।
পরিশেষে, আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে, একটি মানবিক সংকটের উত্তরণে অংশ নিতে হলে, প্রথমেই আমাদের নিজেদের হৃদয়ের আগুনটাকে জ্বালিয়ে রাখতে হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ড একটি উচ্চারণ যেখানে ঘুরে আসছে মানসিক চাপ, হতাশা এবং সম্ভাবনার অভাব। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কেবল সরকারের সোমরূপের প্রয়োজন নেই, বরং আমাদের বাস্তবায়ন জরুরি। দেশ এবং আন্তর্জাতিক স্তরের মানবিকতার আওতায় একত্রিত হয়ে, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা এবং মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার পথ খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। শিল্প, সংস্কৃতি, মানবিকতার অবনতির বিরুদ্ধে আমরা যদি একসঙ্গে দাঁড়াই, তবে হয়তো আমাদের সমাজের এক নতুন সূর্যোদয় দেখা দিতে পারে।
আর এই পদক্ষেপগুলির সফল বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সম্প্রদায়, এনজিও, সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এতে করে মানবিক সংকটে থাকা রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে।
এম.এ হাসেম
উন্নয়ন কর্মী ও সমাজ সেবক|