ফাইল ছবি
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গারা অপহরণ, মানবপাচার, মাদক কারবার ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে-জড়িয়ে পড়েছে। নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে তারা এসব অপকর্মে জড়িত বলে স্থানীয় সচেতন মহলের। রোহিঙ্গা শিবিরে নামে-বেনামে গড়ে উঠেছে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। প্রত্যেকের হাতে রয়েছে দেশি-বিদেশি ভারী অস্ত্র।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নির্যাতনে পালিয়ে আসে এসব রোহিঙ্গারা। আশ্রয় নেয় উখিয়া-টেকনাফ আশ্রয় শিবিরে। রোহিঙ্গা সঙ্কট আট বছর অতিবাহিত হলেও সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আতঙ্ক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে বড় ধরনের ১০টি সশস্ত্র ও ছোট -বড় মিলে রোহিঙ্গা আরো অর্ধশতাধিক গ্রুপ রয়েছে। বড় গ্রুপের মধ্যে, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন অর্গানাইজেশন (এআরএসও)। এসব বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সীমা-পরিসীমা নাই।
সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২৪,১৫,১৬,১৮,১৭ ও ২৬ এ অবস্থানরত সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরা হলেন- ব্লক-সি এর হামিদ হোসেনের ছেলে আবুল কালাম, নুর হাকিম এর ছেলে জুনায়েদ প্রকাশ লাম্বু, কবির আহমেদের ছেলে নূর আহাম্মদ, হুসেন আহমদের ছেলে মোহাম্মদ ইসমাইল, শফিউল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ জুবায়ের, আবুল কাশেমের ছেলে আব্দুল্লাহ, নূর হোসেনের ছেলে হাবিবুল্লাহ, মোহাম্মদ ইউসুফ এর ছেলে মোহাম্মদ ইউনুস, হামিদ হোসেনের ছেলে সবি আলম। ব্লক-বি এর কালামিয়ার ছেলে মোহাম্মদ ওমর, নূর হোসেনের ছেলে নুর ইসলাম, জকরিয়ার ছেলে মুহাম্মদ ইউনুস। ব্লক-এ এর শায়ের মোহাম্মদের ছেলে নুর কামাল। ব্লক-এফ এর ফজে আহমেদ এর ছেলে ছৈয়দ হোসাইন। নয়া পাড়া রেজিস্টার ক্যাম্পের আব্দুল করিমের ছেলে মো. হাসান, গফুরের ছেলে মো. রুবেল,মোহাম্মদ মুছা,লালু,আকিজ,কাসিব,মৌলভি রফিক,মাস্টার সেলিম, আলি জুহার ও রুবিয়া।
এরা সবাই অপহরণ, ইয়াবা, মানবপাচার থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যদের হাতে দেশি-বিদেশি সহ ভারী অস্ত্র রয়েছে বলে জানা যায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, গত বছরের শুরু থেকে এ বছর পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপরাধের মূলে আড়াইশ’র অধিক মামলা হয়েছে। খুনের মামলা অন্তত ৫০টিরও উপরে। মাদক সম্পৃক্ত মামলা সবচেয়ে বেশি। যার সংখ্যা দেড় শতাধিকেরও বেশি। একই সঙ্গে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা রয়েছে।
বিগত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা (যার সংখ্যা বর্তমানে ১৮ লাখের বেশি) বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এরপর গত ৮ বছরে সাড়ে তিন শতাধিক বিভিন্ন ঘটনায় তিনশ’র অধিক মামলা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোহিঙ্গা শিবিরে কিছু সন্ত্রাসীদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু ডাকাত মিলে এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। তাদের প্রধান টার্গেট অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়। অপহরণ বাণিজ্যে ১২ গ্রুপের শতাধিক ব্যক্তি জড়িত বলে জানা যায় অনুসন্ধানে। তারা অত্যাধুনিক মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে, মুহুর্তে অবস্থান পরিবর্তন করে এবং পাহাড়ি দুর্গম পথ ব্যবহার করায় অভিযান চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
রোহিঙ্গা শিবির-১৯ এর আজিম উল্লাহর সাথে কথা বলে জানা যায়, ক্যাম্পগুলো সন্ত্রাসীদের আঁতুড় ঘরে পরিণত হয়েছে। এসব সন্ত্রাসীদের ভয়ে আমরা কোনো কাজকর্ম করতে পারি না। মনে হয়, পুরো ক্যাম্প যেন তাদের। আর ক্যাম্পে যেসব সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে তারা যেন একটি আরেকটির পূর্ব শত্রু।
তারা রোহিঙ্গাদের ঘরে থাকা তরুণদের নিজেদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির প্রতিযোগিতায় রয়েছে। যদি কোনো একটি দলের সদস্য হয়ে থাকে, তাহলে অন্য গোষ্ঠীগুলোর টার্গেটে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। এ রোহিঙ্গাদের অপরাধের শেষ নেই। আরাকানে টিকতে না পেরে চলে আসলাম বাংলাদেশে। এখানে এসেও শান্তি নেই। একদিকে এই গ্রুপ, আরেকদিকে আরেক গ্রুপ। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য হওয়া লাগে। সদস্য না হলে আরেক বিপদ। না হয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো টার্গেট করে হত্যা করে, না হয় ঘুম করে ফেলে। কোনো কোনো সময় রোহিঙ্গা পক্ষের শক্তি বাড়ানোর কথা বলে তারা এসব অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা নাগরিক বলেন, আব্দুল করিম গ্রুপ খুবই ভয়াবহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের ধরে ধরে অমানবিক নির্যাতন করে আসছে নিয়মিত। তারা সবচেয়ে বেশি মানবপাচার ও অপহরণের কাজ করে। তারা অপহরণ করার পর মুক্তিপণ না পেলে দালালের মাধ্যমে বিক্রি করে দিয়ে মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশে পাচার করে দেয়। মাঝেমধ্যে মুক্তিপণ না পেলে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন, এমনকি হত্যাও করে ফেলে।
এদিকে গত ১৯ সেপ্টেম্বর অপহরণের পর মুক্তিপণ না পেয়ে সাগরপথে মালেশিয়া পাচারের সময় মানবপাচারকারীর আস্তানা থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড এর যৌথ প্রচেষ্টায় নারী-শিশুসহ ৬৬ দেশি ও রোহিঙ্গা নাগরিককে উদ্ধার করা হয়। একইভাবে গত ২২ সেপ্টেম্বর র্যাব ও বিজিবির যৌথ প্রচেষ্টায় ৮৪ জন দেশি ও রোহিঙ্গা নাগরিককে উদ্ধার করা হয়। এসব অপহরণ ও মানবপাচারের সাথে রোহিঙ্গা ও দেশিয় সন্ত্রাসী গ্রুপ জড়িত আছে বলে জানান, টেকনাফ ২বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২৪ এর মাঝি মো. আলম জানান, অপহরণ ও মানব পাচারের ভয়ে আতঙ্ক রয়েছে পুরো ক্যাম্প জুড়ে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা সাধারণ রোহিঙ্গাদের ধরে নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেধে অমানবিক নির্যাতন করে। তাদের দাবি অনুযায়ী মুক্তিপণ না মিললে নির্যাতনের মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে যায়।
র্যাব ও বিজিবি সূত্রে জানা যায়, অপরাধ প্রবণতা এখন রোহিঙ্গা শিবিরে সবচেয়ে বেশি। রোহিঙ্গা দালালের সহায়তায় দেশিয় দালাল চক্র মিলে অপহরণ, মানবপাচার ও খুনের মতো সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করে আসছে। স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গাদের লাগাম টানা এখন সময়ের দাবি। অপহরণ ও মানব পাচার বন্ধ করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনগণ সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। যেহেতু রোহিঙ্গা অপহরণকারীরা গহীন পাহাড়ে অবস্থান করে সেহেতু তাদের আস্তানা খোঁজে খোঁজে অভিযান চালাতে হবে। অন্যথায় এসব অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্য থামানো যাবে না। তাদের এ অপরাধ কার্যক্রম দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশেষ করে, সম্পৃক্ত থাকা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আগে প্রতিহত করতে হবে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী জানান, টেকনাফে একটা নির্দিষ্ট সময় বিশেষ করে শীতকালে অপরাধ প্রবণতা খুব বেশি বেড়ে যায়। এরই মধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। রোহিঙ্গা এবং কিছু স্থানীয় মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে অপহরণ করে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মানব পাচারকারী চক্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভিকটিমও উদ্ধার করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো জানান, একইভাবে টেকনাফ যেহেতু দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকা, অপহরণকারী ও কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সেখানে বসবাস করে। স্থানীয় লোকজন ও মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত কিছু রোহিঙ্গা অপহরণ কাজে জড়িত রয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু অপহরণ চক্র বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে। যারা এসব অপহরণ চক্র ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।