বেশির ভাগই কিশোর-তরুণ, মাদক প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রয়োগসহ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার তাগিদ
রাজধানী সহ সারা দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ব্যাপকহারে বাড়ছে। আক্রান্তদের মধ্যে সর্বাধিক কিশোর থেকে তরুণ বয়সীরা। নারীদের সংখ্যা খুবই কম। আক্রান্তদের সম্পর্কে ভয়ংকর তথ্য জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা জানান, মাদকাসক্তদের মধ্যে কিশোর ও তরুণরা (১৫ থেকে ২৫ বছর) সবচেয়ে বেশি জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্তদের মধ্যে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। এর মধ্যে শিক্ষিত তরুণদের সংখ্যাই বেশি। এছাড়া ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ প্রায় সব পেশার লোক রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, মাদকাসক্তদের মধ্যে কিডনি, লিভার, স্ট্রোক, ক্যানসারসহ জটিল রোগে আক্রান্তের সংখ্যাই বেশি। এদের মধ্যে মৃত্যুর হারও বাড়ছে। সর্বনাশা মাদকের আগ্রাসন প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও অভিভাবকদের নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৭ সালে সরকারিভাবে দেশব্যাপী মাদকাসক্তদের নিয়ে জরিপ করা হয়। সেই জরিপ অনুযায়ী দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৮৩ লাখ। এদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সের সংখ্যা সর্বাধিক। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে মাদকাসক্তের সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বেশি হবে।
কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, মাদকাসক্তদের মধ্যে নেফ্রাইটিস, কিডনি ফেইলউর, হঠাত্ কিডনি বিকল ও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। মাদকাসক্তদের মধ্যে কিডনি রোগে আক্রান্ত তরুণদের সংখ্যাই বেশি। মাদক কারবার ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া তরুণ সমাজকে রক্ষা কঠিন হয়ে পড়বে বলে তিনি জানান।
মেডিসিনের অন্যতম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, তরুণদের সিংহভাগই মাদকাসক্ত হয়ে অকালে মারা যাচ্ছে। লিভার ও প্যানক্রিয়াসে ক্যানসারসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে মাদকাসক্তরা। তাদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি।
নিউরো সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের যুগ্ম-পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেন, দীর্ঘদিন মাদক সেবন করার ফলে অনেকের নার্ভও ড্যামেজ হয়ে যাচ্ছে। অনিন্দ্রা বেশি থাকে। তাদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার বেশি। তাদের মধ্যে নিউরোপ্যাথিতে আক্রান্তের হারও অনেক। অর্থাৎ হাঁটতে পারে না, শক্তি পায় না ও শরীর অবশ হয়ে যায় এবং বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন হয়ে পরবর্তী সময় পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। অকালে মাদকাসক্ত তরুণদের মৃত্যু হচ্ছে বেশি।
প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ব্যাপকহারে মাদকদ্রব্য দেশে আসছে এবং একই হারে মাদকাসক্ত হচ্ছে। স্কুলগামী থেকে কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে মাদকাসক্তদের সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্তদের মধ্যে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সের সংখ্যা সর্বাধিক। একপর্যায়ে তারা দানব হয়ে যায়। তাদের মধ্যে মানবতাবোধ বলতে কিছুই থাকে না। এ অবস্থায় তাদের ভালোবাসা কিংবা আদর-যত্ন করে চিকিৎসাসেবা দিলে বেশির ভাগ সুস্থ হয়ে যায়। তবে অধিকাংশ মাদকাসক্ত চিকিৎসা নিতে আসে না কিংবা অভিভাবকরা তাদের আনতে পারেন না।
চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এন হুদা বলেন, মাদকাসক্তরা স্থায়ীভাবে যৌন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। দেহের গুরুত্বপূর্ণ অর্গানগুলো ড্যামেজ হয়ে যায়। ঠিকমতো ঘুমায় না এবং নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অবস্থান করে। তাদের বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ বেশি হয় বলে তিনি জানান।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদকাসক্তদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা সর্বাধিক। মাদক কেনার টাকা জোগাড় করতে ছিনতাই, ডাকাতি, খুনসহ যে কোনো ধরনের অপরাধ করতে তারা দ্বিধা করে না। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, মাদকাসক্ত একজন মানুষ হিসেবে তাদের মধ্যে সেই চেতনাবোধ থাকে না। মাদকাসক্তরা মা-বাবাকেও হত্যা করতে দ্বিধা করে না। সংবাদপত্রে এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের আহ্বান, সর্বনাশা মাদকের ছোবল থেকে এই তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে রাজনৈতিক দলসহ সব পেশার মানুষকে সমন্বিতভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
এদিকে উখিয়া-টেকনাফ, ঘুনধুম,সিলেট, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোরসহ সব সীমান্ত দিয়ে মাদক দেশে প্রবেশ করছে। কোনোভাবে মাদক পাচার রোধ করা যাচ্ছে না। একাধিক কর্মকর্তা এর সত্যতা স্বীকার করেছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার মতে মাদকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র, জনতা সমন্বিতভাবে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে এর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। পাশাপাশি থাকতে হবে আইনের কঠোর প্রয়োগ।
এ প্রসঙ্গে র্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি মো. এ কে এম শাহিদুর রহমান বাংলার সীমান্তকে বলেন, র্যাবের পক্ষ হতে মাদক কারবারিদের গ্রেফতার ও মাদক উদ্ধার অভিযান অব্যাহতভাবে চলছে। বড় ধরনের সামাজিক আন্দোলন ছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলসহ সব পেশার মানুষ ও অভিভাবকদের অংশগ্রহণ থাকতে হবে।